লাইফস্টাইলহেলথ

মাসিক না হওয়ার কারন

একজন নারী কিনবা একজন আদর্শ স্বামী, সচেতন বাবা বা দায়িত্বশীল ভাই,সবারই মাসিক সংক্রান্ত কিছু প্রয়োজনিয় বিষয় জেনে রাখা দরকার। যেমন- মাসিক না হওয়ার কারন, এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের উপায়। কেননা অসুস্থতা কোনো লজ্জার বিষয় নয়, পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই। তাই আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় মাসিক না হওয়ার কারন, এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও অনিয়মিত মাসিক প্রতিরোধ এবং এ রোগ প্রতিকারের উপায়।

 

১২ থেকে ৫৫ বছর বয়সী নারীদের একটা নির্দিষ্ট সময় (সাধারনত ২৮ থেকে ৩৫ দিন) পর পর মাসিক বা পিরিয়ড হয়ে থাকে। নারীদের নিয়মিত এবং সময় মতো পিরিয়ড বা মাসিক হওয়াটাই স্বাভাবিক। নিয়মিত মাসিক নারীদের শরীরের হরমোনাল ভারসাম্য বজায় রাখে। তবে,অনিয়মিত মাসিক বা সময় মতো মাসিক না হওয়া, অনেক নারীরই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, অনিয়মিত মাসিক থেকে বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতা সৃষ্টি হয়ে থাকে।

 

মাসিক না হওয়ার কারন
মাসিক না হওয়ার কারন

 

যে কোনো বয়সের নারীদেরই মাসিক না হওয়ার বা অনিয়মিত মাসিক সংক্রান্ত সমস্যা হতে পারে। বেশির ভাগ নারীর মাসিক/ পিরিয়ড নিয়মিত একটা নির্দিষ্ট চক্র অনুসারে হয়। যেমন কারো মাসিক ২৮দিন পর পর হতে পারে। নিয়মিত যে সময়ে মাসিক হয় তার থেকে ৭দিন বা এক সপ্তাহ পর্যন্ত দেরি হওয়াকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়া যায়। তবে, যদি কোনো নারীর মাসিক ২১ দিনের আগে বা ৩৫ দিনের পরে এবং মাসিকের স্থায়িত্ব ৩ দিনের বেশি বা ৭ দিনের কম হয় তবে তাকে অনিয়মিত ঋতুচক্র বা অনিয়মিত মাসিক বলা হয়ে থাকে।

নিয়মিত মাসিক না হওয়া থেকে যেসব স্বাস্থ্য জটিলতা হতে পারেঃ

  • নিয়মিত মাসিক না হওয়ার ফলে অনেক সময় গর্ভধারণের ক্ষমতা কমে যেতে পারে।
  • কোনো একমাসে মাসিকের রক্তপাত বেশি হতে পারে আবার অন্য মাসে তা একেবারে কমে যেতে পারে।অর্থাৎ কোন মাসে পিরিয়ডের ন্সময় রক্তপাত খুব বেশি এবং কোন মাসে খুব কম হতে পারে।
  • নিয়মিত মাসিক না হওয়ার ফলে অনেক সময় নারীদের মানসিক অশান্তি হতে পারে।
  • নিয়মিত মাসিক না হওয়ার কারনে নারীদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যেতে পারে।
  • কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ হয়ে যেতে পারে।
  • অনিয়মিত মাসিক সমস্যার জন্যে বেশি সময় ধরে এবং পরিমাণে বেশি রক্তপাত হতে পারে।

 

চলুন এবার জেনে নেই মাসিক না হওয়ার কারনগুলিঃ

 

  •         গর্ভাবস্থা: যারা বিবাহিত বা নিয়মিত যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয় তাদের মাসিক সময় মতো না হলে বা পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে পরলে অবশ্যই প্রথমেই নিশ্চিত হতে হবে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে কিনা। কেননা গর্ভবতী হওয়ার কারণে নারীদের পিরিয়ড বন্ধ হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে পিরিয়ড বন্ধ থাকার সাথে আরোও কিছু উপসর্গ থাকে, যেমন- মাথা ঘোরা, গা গোলানো, ক্লান্তি ভাব ইত্যাদি।
  •         শরীরের ওজন কম থাকা বা হঠাৎ ওজন বেড়ে যাওয়াঃ অনেক সময় শরীরের ওজন কম থাকার জন্যে নারীদের নিয়মিত পিরিয়িড বা মাসিক নাও হতে পারে। এমনকি মাসিক কিছুদিন বন্ধও থাকতে পারে। আবার হঠাৎ ওজন বেড়ে গেলেও অনেক সময় মাসিক হয় না।
  •         শরীরে পানির ঘাটতিঃ পানির ঘাটতি থেকে ইউরেটরে ইনফেকশন হতে পারে। আর ইউরেটরে ইনফেকশনের কারনে অনেক সময় মাসিক হয় না।
  •         আর্লি প্রেগন্যান্সি লস: যদি একজন নারী গর্ভবতী হওয়ার পরও, সে তা বুঝতে না পারে। সেক্ষেত্রে অনেক সময় নিজে থেকেই তার গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে। এমন ঘটনার ক্ষেত্রে সাধারণ পিরিয়ডের তুলনায় কিছুদিন পর ভারী রক্তপাত হতে পারে, যাকে অনেকেই দেরিতে মাসিক হওয়া ভেবে নেন।
  •         রক্তশূন্যতা বা ক্যালসিয়ামের অভাবেঃ নারীদের শরীরে রক্তশূন্যতা হলে অনেক সময় পিরিয়ড হতে বিলম্ব হতে পারে। তাছাড়া ক্যালসিয়ামের অভাবেও অনেক সময় মাসিক হয় না।
  •         পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমঃ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম রোগের কারনে যেসব নারীদের কখনো যৌন সম্পর্ক হয়নি তাদের মাসিক বন্ধ হয়ে যায় । এ রোগেরর আরোও কিছু লক্ষণ হলো- ওজন বেড়ে যাওয়া,শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অবাঞ্ছিত লোম গজানো এমনকি মুখেও তাছাড়া অনেক সময়  ছেলেদের মতো টাক পড়ে। এ রোগ থাকলে যেমনি মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায়, তেমনি আবার যখন মাসিক হয় তখন অনেক বেশি রক্তপাত হয় যার ফলে রক্তস্বল্পতায় শঙ্কাও দেখা দেয়।
  •         বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যাঃ ঠাণ্ডা,জ্বর,সর্দি,গলার ইনফেকশন এসব স্বাস্থ্য সমস্যায় জন্যে অনেক সময় পিরিয়ড দেরিতে হতে পারে। এছাড়াও কিশোরী বয়সে অনেক সময় ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের ভারসাম্যে তারতম্যের জন্যে অনেক সময় মাসিক হয় না।

 

মাসিক-না-হওয়ার-কারন
মাসিক-না-হওয়ার-কারন

 

  •         অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহনঃ যেসব খাবারে ক্যাফেইন আছে এমন সব খাবার অতি মাত্রায় গ্রহণ করার ফলে  মাসিক দেরিতে হতে পারে। যাদের অতিরিক্ত কফি পান করার অভ্যাস আছে তাদের অনেক সময় মাসিক হয় না।
  •         পরিবেশের প্রভাবঃ মাসিক নিয়মিত না হওয়ার জন্যে দায়ী থাকতে পারে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেও। কেননা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে  বসবাস করা এবং অপরিচ্ছন্ন থাকার জন্যেও অনেক সময় মাসিক হয় না।
  •         বড় ধরনের কোনো মানসিক আঘাতঃ বড় ধরনের মানসিক আঘাত যেমন কাছের কারো মৃত্যু, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া অর্থাৎ ব্রেকাপসহ বিভিন্ন মানসিক আঘাতের ফলেও অনেক সময় মাসিক হয় না। লম্বা সময় ধরে অতিরিক্ত মানুষিক চাপে থাকার কারনে মাসিকের এ সমস্যা দেখা দেয়।
  •         জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিঃ বার্থ কন্ট্রোল বা জম্ননিয়ন্ত্রের বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বনের জন্যে অনেক সময় মাসিক হয় না। । যেমন- জম্ননিয়ন্ত্রনের ইনজেকশন, জম্ননিয়ন্ত্রন পিল,আইইউডি ব্যবহারের ফলে পিরিয়ড হতে বিলম্ব হওয়া বা পিরিয়ডের সময় পরিবর্তন হওয়াটা স্বাভাবিক।
  •         মাত্রাতিরিক্ত শরীরচর্চাঃ কোন নারী যদি মাত্রাতিরিক্ত শরীরচর্চা করেন তাহলে মাত্রাতিরিক্ত শরীরচর্চার জন্যে মাসিক নাও হতে পারে।
  •         ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ বিভিন্ন ধরনের ঔষুধ যেমন- পেইন কিলার, থাইরয়েডের ওষুধ, মৃগীরোগের ওষুধ গ্রহনের কারনেও মাসিক বন্ধ থাকতে পারে। তবে এসব ক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
  •         ফাইব্রয়েডস: অনেক সময় জরায়ুতে টিউমারের মতো একধরনের বৃদ্ধি হয় যাকে ফ্রাইব্র্যেডস বলা হয়। ফ্রাইব্র্যেডস মাসিকের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ্য করতে পারে।
  •         এন্ডোমেট্রিওসিস এবং থাইরয়েডের সমস্যাঃ এন্ডোমেট্রিওসিসের কারনে অনেক সময় মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া, থাইরয়েডের মাত্রা বাড়লেও মাসিকের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমে আসে আর সেই সাথে হৃদস্পন্দনের হার,অ্যাংজাইটি ও ভয় পাওয়া বেড়ে যায়।

মাসিক না হওয়ার কারনগুলি তো আমরা জেনে নিলাম। কিন্তু শুধু রোগ বা রোগের কারন জানাই যথেষ্ট নয় বরং জানতে হবে রোগ প্রতিরোধের নিয়মগুলিও। তবেই আমরা আমাদের মাসিক সংক্রান্ত বিভিন্ন স্বাস্থ্য  জটিলতা থেকে পরিত্রান পাবো এবং মাসিক না হওয়ার মতো শারীরিক অসুস্থতা থেকে দূরে থাকতে পারবো অর্থাৎ সুস্থ্য থাকতে পারবো। তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক কয়েকটি ঘরোয়া সমাধান যেসব প্রয়োগ করে আমরা অনিয়মিত মাসিক সমস্যা থেকে প্রতিকার পেতে পারি-

  •         কাঁচা পেপে: কাঁচা পেপে মাসিক নিয়মিত হতে সাহায্য করে। ব্যবহারবিধিঃ নিয়মিত কয়েক মাস কাঁচা পেপের রস খেলে মাসিক নিয়মিত হয়। সতর্কতাঃ মাসিক চলাকালে কাঁচা পেপের রস না খাওয়াই ভালো। মাসিক নিয়মিতকরণ ছাড়াও কাঁচা পেপে হজমে সাহায়ক এবং ক্যান্সার প্রতিরোধী।
  •        অ্যালোভেরা: অ্যালোভেরা মাসিক নিয়মিত করতে বেশ কাজের। অ্যালোভেরা হরমোন রেগুলেশন-এ সাহায্য করে। ব্যবহারবিধিঃ নিয়মিত সকালে খালি পেটে তাজা অ্যালোভেরা পাতার রসের সাথে সামান্য মধু মিশিয়ে খেতে হবে। সতর্কতাঃ পিরিয়ড চলাকালীন না খাওয়াই ভালো।
  •        প্রচুর পানি পান করাঃ পানির ঘাটতি থেকে ইউরেটরে ইনফেকশন সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে মাসিক হতে বিলম্ব হয়। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
  •        দারুচিনি: দারুচিনি মাসিক নিয়মিত হতে সাহায্য করে। ব্যবহারবিধিঃ অনিয়মিত মাসিক থেকে মুক্তি পেতে লেবুর রসের সাথে দারুচিনি গুড়া করে মিশিয়ে খেতে হবে। তাছাড়া চায়ের সাথেও খাওয়া যেতে পারে দারুচিনি গুড়া। এটি মাসিক নিয়মিত করার পাশাপাশি মাসিকের ব্যথা খানিকটা কমাবে।
  •         আদা: অনিয়মিত মাসিক বা মাসিক না হওয়া সমস্যার ক্ষেত্রে আদা ভালো কাজে আসে। ব্যবহারবিধিঃ ১ কাপ পানিতে ১ চা চামচ আদা কুঁচি নিয়ে ৫-৭ মিনিট ফুটিয়ে নিতে হবে ।তারপর এর সঙ্গে সামান্য পরিমাণে মধু মিশিয়ে নিতে হবে (মধু না থাকলে চিনি হলেও চলবে)। খাবার খাওয়ার পর পানীয়টি তিন বেলাই খেতে হবে। মনে রাখতে হবেঃ এই পানীয়টি ভরা পেটে খেতে হবে। কয়েক মাসের মধ্যেই মাসিক নিয়মিত হতে শুরু করবে। আদা মাসিক নিয়মিতকরণে সাহায্য করে।
  •         কাঁচা হলুদ: হলুদ শরীরে হরমোনের ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে। কাঁচা হলুদ মাসিক নিয়মিতকরণের পাশাপাশি মাসিকের ব্যথা কমাতেও সাহায্য করে। ব্যবহারবিধিঃ এক কাপ দুধে চা চামচের চার ভাগের এক ভাগ কাঁচা হলুদ নিয়ে মধু,গুড় বা চিনি  দিয়ে কিছুদিন খেতে হবে।
  •         যোগ-ব্যায়াম ও মেডিটেশন: স্ট্রেস বা মানসিক চাপের জন্যেও অনেক সময় মাসিক হয় না। শরীরের যে সমস্ত হরমোন মাসিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে স্ট্রেস সেগুলোর ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।ফলে মাসিক হয় না। যোগ-ব্যায়াম ও মেডিটেশন মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। মাসিক নিয়মিত করতে অন্যতম সেরা পদ্ধতি যোগ-ব্যায়াম ও মেডিটেশন।

 গর্ভবতী হওয়ার লক্ষণ- জেনে নিন 5 টি উপায়ে

 

আশা করা যায় উল্লেখিত পদ্ধতিসমূহ সঠিক ভাবে প্রয়োগ করলে মাসিক না হওয়া বা অনিয়মিত মাসিক সমস্যা থেকে পরিত্রান পাওয়া যাবে। তবে সব থেকে ভালো হয় যদি ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া যায়।

চলুন এবার জেনে নেই কি কি পরিস্থিতিতে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। যেসব সমস্যার জন্যে ডাক্তারের শরনাপন্ন হওয়া উচিত তা হলোঃ

  •         মাসিকের স্থায়িত্ব যদি ৭ দিনের অধিক বা ৩দিনের কম হয়।
  •         মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত হলে এবং পেতে অসহ্য ব্যথা অনুভব করলে।
  •         মাসিকের ব্যবধান ২১ দিনের কম বা ৩৫ দিনের বেশি হলে।
  •         দুই মাসিকের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকলে।
  •         এক টানা তিন মাস মাসিক না হলে।
  •         বছরে ৯ বারের কম মাসিক হলে।
  •         মাসিক খুব বেশি যন্ত্রণাদায়ক হলে, যৌন সঙ্গমের সময় এবং শেষে ব্যথা থাকলে, মলত্যাগের সময়েও তীব্র ব্যথা অনুভব করলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

 

 যেকোনো ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতা এড়িয়ে চলতে হলে সুষম খাদ্য গ্রহন করতে হবে,পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে এবং কায়িক পরিশ্রম বা হালকা ব্যায়াম করতে হবে।

 

তথ্য সমন্বয় : উইকিপিডিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button