লাইফস্টাইলহেলথ

জ্বর না কমার কারণ

জ্বর খুব সাধারন একটা অসুখ। আমরা প্রায় সকলেই বছরের বিভিন্ন সময় জ্বরে আক্রান্ত হয়ে থাকি। অনেকে তো আবার বছরে ৩/৪ বার বা তারও বেশি বার আক্রান্ত হয়ে থাকে। জ্বর হলে আমরা সাধারনত বাসাতেই চিকিৎসা গ্রহন করে থাকি। অনেক সময় বাসায় প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়ার পরও জ্বর কমে না। যেকোনো সমস্যা মূল কারণটা নির্ধারন করতে পারলে সমস্যার সমাধান করা সহজ হয়। তাই আজ আমরা আলোচনা করবো জ্বর না কমার কারণ ও জ্বর না কমলে করণীয় সম্পর্কে।

 জ্বর বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। সাধারনত বৃষ্টিতে ভেজা, ঋতুর পরিবর্তন, নারীদের পিরিয়ডের কারণে, টিকা নিলে, প্রস্রাবে ইনফেকশন হলে, আকস্মিক পাওয়া শারীরিক বা মানসিক আঘাতের ফলে কিনবা ভাইরাসের সংক্রমনের ফলে জ্বর হতে পারে। তাছাড়া  বিভিন্ন জটিল রোগ যেমন- করোনা ভাইরাসের সংক্রমন, চুকুনগুণিয়া, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ও টাইফয়েডসহ বিভিন্ন রোগের উপসর্গ হিসেবেও জ্বর হতে পারে। এসব জ্বর রোগীর জন্যে বিপদের কারণ হতে পারে। এ ধরনের জ্বর জটিল রোগের উপসর্গ হাওয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহনেও এ জ্বর কমে না। এসব জ্বরের ক্ষেত্রে সময় মতো সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারলে অনেক সময় রোগীর মৃত্যুর কারণ ও হতে পারে।

জ্বর না কমার কারণঃ

 

  •         দূর্বল ইমিউন সিস্টেমঃ  জ্বর না কমার কারণ হতে পারে দূর্বল ইমিউন সিস্টেম সবার শরীরেরই একটা নিজেস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকে। যা বাহ্যিক কোনো জীবানুর আক্রমন থেকে শরীরকে রক্ষা করে। ইমিউন সিস্টেম বলতে মূলত সেই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেই বুঝায়। বিভিন্ন কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। অর্থাৎ ইমিউন সিস্টেম দূর্বল হয়ে যেতে পারে। কারো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল হলে সহজেই তাকে বিভিন্ন রোগ জীবানু আক্রমন করে কাবু করে ফেলতে পারে। তাছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল হয়ে গেলে কিনবা নষ্ট হয়ে গেলে ঐ ব্যক্তির কোনো রোগ হলে সহজে রোগ সারতেও চাই না। ইমিউন সিস্টেম দূর্বল হওয়ায় শরীর জীবানু বা রোগের সাথে লড়তে পারে না।

 

  •         কুসংস্কারঃ জ্বরের ক্ষেত্রে প্রয়োজন রোগীর সঠিক চিকিৎসা। কিন্তু আমাদের সমাজে জ্বর নিয়ে এখনো বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার রয়েছে। সে সব কুসংস্কার মেনে চিকিৎসা করার কারণে জ্বর তো কমেই না বরং কুসংস্কারগুলি কিছু কিছু ক্ষেত্রে জ্বর বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। যেমন- আমাদের সমাজের অনেকেই এখনোও বিশ্বাস করে জ্বর ও ঠান্ডা – কাশিতে কোনো প্রকারের ফলই খাওয়া যাবে না। যেটা সম্পূর্ণ ভুলন ধারনা। কেননা চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল ঠান্ডা কাশি দূর করতে বেশ কার্যকর। আবার অনেকেই মনে করেন, জ্বর হলে গোসল করা যাবে না। কিন্তু ধারনাটি ঠিক নয়। কারণ চিকিৎসকরা বলছেন, জ্বরের ক্ষেত্রে হালকা গরম পানিতে গোসল করা যেতে পারে যা জ্বর কমানোর পাশাপাশি শরীর ও মন চনমনে রাখবে।

 

  •         বিভিন্ন জটিল রোগের উপসর্গঃ সাধারনত জ্বর বাসায় বিশ্রাম নিলে ও ঘরোয়া চিকিৎসা নিলে ২/৩ দিনের মাঝেই কমে যায়। কিন্তু ঘরোয়া চিকিৎসা ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়ার পরও যদি ২/৩ দিনের মাঝে জ্বর না কমে তাহলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে জ্বর জটিল কোনো রোগের উপসর্গ হতে পারে। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, করোনা ভাইরাস, চিকুনগুনিয়াসিহ আরোও বিভিন্ন রোগের লক্ষন হিসেবে জ্বর থাকতে পারে। এসব রোগের ক্ষেত্রে সাধারণ জ্বরের চিকিৎসা নিলেও জ্বর কমে না।

 

  •         ঠান্ডা পানিতে গোসল করাঃ অনেকেই জ্বর আসলে ঠান্ডা পানিতে গোসল করে। এমনকি অনেকে তো বরফ দেয়া পানিতেও গোসল করে থাকে। ঠান্ডা পানিতে গোসলে জ্বর তো কমেই না বরং জ্বর বেড়ে যাবার সাথে সাথে কাপুনি ও শুরু হতে পারে।

 

  •         ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়টিক গ্রহণঃ অনেকেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজের ইচ্ছানুসারে এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করে। এভাবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক গ্রহণ এবং এন্টিবায়োটিক এর সম্পূর্ন কোর্স সম্পন্ন না করার ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে। এমন অবস্থায় পরবর্তীতে অনেক এন্টিবায়োটিক শরীরে আর আজ করে না। সেক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিকও জ্বর কমাতে পারে না।

 

  •         মদ্যপানঃ এক গবেষণায় দেখা গেছে, মদ্যপানের ফলে ইমিউন সিস্টেম ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত দূর্বল থাকে। অ্যালকোহল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টিকারী কোষগুলির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই মদ্যপান হতে পারে জ্বর না কমার অন্যতম কারণ। তাছাড়া ধূমপানও ইমিউন ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে তাই ধূমপান ও মদ্যপান জ্বর না কমার কারণ হতে পারে।

 

  •         বিশ্রাম না নেয়াঃ জ্বরের সময় এমনিতেই শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকে। তাই এ সময় শরীর বেশি  সক্রিয় থাকলে শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকে। তাই জ্বরের সময় পর্যাপ্ত বিশ্রামে না থাকলে জ্বর কমে না।

 

  •         রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে এমন খাবার গ্রহণঃ জ্বরের সময় শরীরের ইমিউন সিস্টেম আক্রমণকৃত বাহ্যিক জীবাণু ও ভাইরাসের সাথে লড়াই করতে থাকে। এ সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে এমন সব খাবার গ্রহণ করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জীবাণু ও ভাইরাসের সাথে লড়াই করতে ব্যর্থ হয়। এ সব খাবার গ্রহণও জ্বর না কমার অন্যতম কারণ।

জ্বর না কমার কারণ তো জেনে নিলামকিন্তু শুধু সমস্যা জানাই তো যথেষ্ট নয়।। জানতে হবে সমস্যার সমাধানও। তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক জ্বর না কমলে করণীয় সমূহ।

 

জ্বর ও পাতলা পায়খানা হলে করণীয়

 

 

শিশুদের জ্বর হলে করণীয়

 

জ্বর না কমলে করণীয়

  •         গোসলঃ অনেকেই মনে করে জ্বর হলে গোসল করা উচিত না। এটা সম্পূর্ন ভুল ধারনা। জ্বরের সময় কুসুম গরম পানিতে গোসল করলে শরীরের তাপমাত্রা অনেক টাই কমে যায়। তাছাড়া মনটাও চনমনে থাকে। তবে ঠান্ডা পানি বা বরফ পানি দিয়ে কোনো ভাবেই গোসল করা ঠিক না। এতে জ্বর বেড়ে যেতে পারে এবং রোগীর কাপুনিও হতে পারে।
  •         জলপট্টিঃ কাপড় পানিতে ভিজিয়ে তা দিয়ে মাথায় ও ঘাড়ে জলপট্টি দেয়া যেতে পারে। এতে জ্বর কমার পাশাপাশি রোগী অনেকটা স্বস্তিও অনুভব করবে।
  •         শরীর মুছে দেয়াঃ কুসুম গরম পানিতে গামছা বা টাওয়েল ভিজিয়ে তা দিয়ে রোগীর শরীর মুছে দেয়া যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে দ্রুত জ্বর কমানো সম্ভব।
  •         এন্টিবায়োটিক গ্রহণঃ জ্বর না কমলে ডাক্তারের পরামর্শে এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করা যেতে পারে। কোনো অবস্থাতেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করা উচিত নয়। এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করা শুরু করলে সম্পূর্ণ কোর্স না গ্রহণ করে হঠাৎ এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করা বাদ দেয়া যাবে না।
  •         বরফের ব্যবহারঃ শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেশি বেড়ে গেলে বগলের নিচে বা কুঁচকিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো পরিষ্কার কাপড়, গামছা কিনবা টাওয়েলে কয়েক টুকরো বরফ নিয়ে বগলের নিচে বা কুঁচকিতে চেপে ধরে রাখলে ( ১০ থেকে ১৫ মিনিট এগুলো রাখা যাবে) শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত কমবে। এসব বগল ও কুঁচকির রক্তনালীগুলি অধিক প্রশস্ত হওয়ায় দ্রুত শরীর ঠান্ডা করতে পারে।
  •         পানি পানঃ জ্বরের সময় শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি থাকে তাই শরীরে পানি শুন্যতা দেখা দিতে পারে। পানি শুন্যতা প্রতিরোধের জন্যে জ্বরের সময় প্রচুর পানি পান করা উচিত। পানি ছাড়াও বিভিন্ন তরল খাদ্য যেমন- ডাবের পানি, ফলের রস, চিড়ার পানি, শিশুদের ক্ষেত্রে ভাতের মার ও মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো যেতে পারে।
  •         স্বল্প পরিমাণে বার বার খাবার গ্রহনঃ জ্বরের সময় একসাথে অধিক খাবার খাওয়া ঠিক না। অধিক খাবার যেমন বদ হজমের কারণ হতে পারে তেমনি শরীরে অধিক তাপও উৎপাদন করতে পারে। তাই এসময় পুষ্টিকর খাবার অল্প অল্প করে বার বার খাওয়া উচিত।
  •         আদাঃ আদার ঔষুধীগুন সম্পর্কে তো আমরা সবাই জানি। আদা জ্বর কমাতেও অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখে। যেভাবে খেতে হবেঃ ১ চা চামচ লেবুর রস,  ১/২ চা চামচ আদা ও ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে মিশ্রণটি দিনে ৩/৪ বার খাওয়া যেতে পারে। এতে জ্বর অনেকটাই কম থাকবে। কারণ এটি শরীরের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। ভাইরাসজিনিত রোগের ক্ষেত্রে আদা, মধু, লেবুর রস বেশ কার্যকর উপাদান।
  •         যেসব ক্ষেত্রে ডাক্তারের কাছে যেতে হবেঃ ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে আক্রান্ত হবার ৩ দিনের মধ্যেই চিকিৎসা শুরু করা উত্তম। তাই জ্বরে আক্রান্ত হলে ডেঙ্গুর লক্ষণগুলির দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ডেঙ্গুর লক্ষনগুলো হলো- প্রচুর জ্বর, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, শরীরে ছোপ ছোপ দাগ।

ডেঙ্গু ছাড়াও জ্বর আরো অনেক রোগের উপসর্গ হিসেবে দেখা দিতে পারে। তাই জ্বর যদি অত্যন্ত বেশি হয়, শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে, জ্বরের সাথে যদি ঘনঘন প্রস্রাব হয় বা প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করে, পিঠের নিচের দিকে ব্যথা, ঘাড় ব্যথা থাকে, শরীরে র‍্যাশ উঠে, প্রচুর বমি হয় বা খাবার খেতে না পারে বা জ্বর যদি ৩ দিনের বেশি সময় স্থায়ী হয় তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।

শিশুদের জ্বর হলে করণীয়ঃ

শিশুকে বিশ্রামে রাখতে হবে, বুকের দুধের পাশাপাশি বিভিন্ন তরল খাবার খাওয়াতে হবে, হালকা গরম পানি দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে, জ্বরের তীব্রতা বেশি থাকলে বা জ্বর ৩দিনের বেশি স্থায়ী হলে কিনবা পানিশূন্যতা দেখা দিলে শিশুকে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। 

 

তথ্য সমন্বয় : উইকিপিডিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button